Friday, 9 May 2014

ফিরে এসেছিল, যে ছিলনা কখনও


by- -তাসমিনুল করিম ইমু

আমার আর নমৃতার গল্পটা হুট করেই শুরু হয়েছিল। নতুন শহরে একা ছিলাম। একদম একা। কোন বন্ধু ছিলনা। আসলে কখনও বন্ধু বানানর চেষ্টাও করিনি। কলেজেও তেমন কোন বন্ধু নেই। শুধু নোটস দেয়া নেয়া হয় ক'জনের সাথে কিন্তু ঐ পর্যন্তই। কিন্তু তাই বলে যে আমার বন্ধু বান্ধবের শখ
ছিলনা তা নয়। কারো সাথে সহজ হতে পারতাম না। প্রতিদিন বিকালে হাঁটাহাঁটি

করতাম বাড়ির সামনের লম্বা রাস্তাটা ধরে। দুইপাশে উঁচু দালানের মাঝখানে রাস্তাটাকেও আমার মতই একা মনে হত। আর তাই বাড়ি, কলেজ, পিসি আর ঐ রাস্তার মাঝেই আমার পৃথিবীটা আটকে ছিল।
ততদিন ছিল যতদিন না নমৃতার সাথে পরিচিত হলাম। সেদিন দুপুরে অঝরে বৃষ্টি নামল আমাদের শহরে। বৃষ্টি থামলে চারিদিক রঙিন করে গোধূলী নামল। আমি হাঁটছিলাম রাস্তা ধরে। আর গুনগুন করছিলাম,

"which way to the fountain of my youth i wonder"

ঠিক তখনই আমাদের পাশের বিল্ডিঙের দোতলার একটা জানালায় চোখ পড়ল আমার। দেখলাম জানালার পর্দা সরিয়ে একটা উৎসুক চেহারা আমার দিকে তাকিয়ে আছে। গোধূলী আভা তার ফর্সা মুখেও আছড়ে পড়ছে মৃদুভাবে। আমি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলাম তার দিকে। মনে হল কিছু একটা বলতে চাইছে সে আমায়। আমি সম্মোহিতের মত দাঁড়িয়ে আছি। একটু পর পর্দার আড়ালে মুখটা হারিয়ে গেল। আমি আরও কিছুটা সময় সেখানে দাঁড়িয়ে রইলাম। ততক্ষণে সাঁঝের আঁধার তার ছিটেফোটা ছড়াতে শুরু করেছে। ফিরে আসলাম আমার ঘরে। প্রতিদিন লিখি যে ডায়েরিতে সেটা বের করে তারিখ দিয়ে পৃষ্ঠার ঠিক মাঝখানে লিখলাম, "মায়াময়"
শুধু একটা শব্দ। সারাটা রাত চেয়ারে বসে কাটিয়ে দিলাম। মেয়েটার কথা ভাবলাম। বারবার চোখে ভেসে উঠছিল সেই জানালার পর্দার আড়ালের ঐ মুখটা। সকালে চেয়ার ছেড়ে উঠতেই কোমরে একটা ব্যাথা অনুভব করলাম। ফ্রেশ হয়ে মায়ের সাথে একটু গল্প করে ব্রেকফাস্ট সেরে নিলাম। সেদিন কলেজে একটা টেস্ট ছিল। পৌঁছাতে লেট হয়ে গেল। পরীক্ষা শেষে বেরিয়ে দেখলাম কালকের সেই মেয়েটা কলেজের মাঠে দাঁড়িয়ে আছে। আমাকেই
দেখছে। কেন জানিনা আমি পা বাড়ালাম ওর দিকে। আমাকে আসতে দেখেও মেয়েটা চলে গেলনা। আমি ওর সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। চেহারায় সেই কালকের মায়া। আমিই কথা শুরু করলাম,
"হাই"
"হ্যালো", অদ্ভুত সুন্দর কন্ঠ মেয়েটার।
"কালকে আপ্নিই ছিলেন জানালায়?"
"হ্যাঁ আমি।"
"ঐ বিল্ডিঙেই থাকেন? আমি পাশের বিল্ডিঙে।"
"আমি সব জায়গাতেই থাকি।" হেসে বলল সে।
"মানে?"
"মানে কিছুনা। আমি নমৃতা।"
"আমি সীমান্ত।"
"আচ্ছা আমি এখন আসি।" বলে উত্তরের অপেক্ষা না করে নমৃতা হাঁটতে থাকল। আমি ডেকে বললাম একসাথে যাবার কথা কারণ পাশাপাশি থাকি আমরা। কিন্তু সে যেন শুনতেই পায়নি এমনভাবে চলে গেল। আজ একটা অপরিচিত মেয়ের সাথে এত কথা বলে ফেললাম। নিজেরই অবাক লাগছে। আপন মনেই হয়ত সেদিন নমৃতাকে নিজের বন্ধুই ভেবে বসলাম। এভাবেই
পরিচয় ওর সাথে। এর পরের কয়টা দিনে নমৃতার সাথে আমার খুব ভাব
হয়ে গেল। আমরা ছাদে গল্প করতাম। ও ওদের ছাদে, আমি আমাদেরটায়। আমরা অনেক গল্প করতাম, ফোনেও। নমৃতা আমাকে বন্ধুত্বের সংজ্ঞা শিখিয়েছিল। একটা সময় এমন হল, কোনকিছু হলে কেউ কাউকে না জানিয়ে থাকতে পারতাম না। প্রতিটা কথা শেয়ার করতাম। ও অনেক সুন্দর
রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে পারত। আমাকে শুনিয়েছে কয়েকবার। দিনগুলো ভালই
কাটছিল। আমাদের ঘনিষ্ঠতাও বেড়ে গিয়েছিল। তবে নমৃতার আচরণ ছিল একটু অদ্ভুত। ও অনেক রাতেও ছাদে থাকত। আমি জিজ্ঞেস করলে বলত, "আমি ছাদে, তারা গুনি।" আমিও ছাদে আসতে চাইলে মানা করে দিত। বলত, "তুমি এখন আমাকে দেখলে চিনতে পারবেনা, হয়ত দেখতেও পাবেনা।" আমি ভীষণ অবাক হতাম। কিন্তু কিছু বলিনি কখনও। ওর কথা অমান্য করে ছাদেও যাইনি। তারপর সেই দিনটা এল যেটা আমাদের বন্ধুত্বের সমীকরণটা পাল্টে দিল।
"সীমান্ত, তুমি একটা জিনিস খেয়াল করেছ?"
"কোনটা?"
"তুমি আমার প্রেমে পড়েছ।"
"হোয়াট? তুমি কিভাবে জানো?"
"আমি সব বুঝতে পারি। ভেবে দেখ। তুমি সত্যিই আমাকে ভালবাসো।"

এই বলে চলে গেল নমৃতা। তারপর পুরো দুটো দিন ও আমার সাথে কথাও বলেনি দেখাও করেনি। আমাদের এই বন্ধুত্বের কথা দুই পরিবারের কেউ জানতনা তাই বাসায় যেয়ে খোঁজ নেয়ার উপায় ছিলনা। এরই মাঝে আমি নমৃতার কথার সত্যতা খুঁজে পেলাম। যদি আমার মধ্যে বয়ে যাওয়া অনুভূতির স্রোতগুলোর নাম ভালবাসা হয়, তাহলে আমি নমৃতাকে ভালবাসি।

"নমৃতা"
"হুম"
"কোথায় ছিলে?"
"তোমার সাথেই ছিলাম। তুমি দেখনি।"
"তোমাকে একটা কথা বলব।"
"জানি, তুমি আমাকে ভালবাস।"
"কিভাবে জানলে?"
"আমিতো আগেই জানতাম। তুমি বরং এখন জানলে।"
"আর তুমি?"
"হ্যাঁ আমিও তোমাকে ভালবাসি।"

নমৃতা লাইন কেটে দিল। আমি ফোন দিয়ে বন্ধ পেলাম। যাইহোক শুরু হল আমাদের গল্প। পথচলা। আমরা অনেক স্বপ্ন সাজাতাম। কিন্তু নমৃতা প্রায়ই
বলত, "সীমান্ত, তুমি জানো? আমি একদিন তোমাকে ছেড়ে চলে যাব, সেদিন আমাদের কথা অপুর্ণ থেকে যাবে। কিন্তু তুমি চিন্তা করোনা। সময় পেলেই আমি তোমাকে নিয়ে যাব আমার সাথে।"
আমি শুনে হাসতাম আর এটা সেটা বলে ওকে রাগাতাম। এরকম খুনসুটিতেই কাটতো দিন। একদিন বাসায় মা ছিলনা। নমৃতা বাসায় এল। আমাকে একেবারেই না জানিয়ে। আমি যার পর নাই আনন্দিত হলাম। আমরা সেদিন অনেক গল্প করেছি। অনেক। সেই আমার স্বপ্নালু কথাবার্তা আর নমৃতার সেই অদ্ভুত ভাবভঙ্গি। গল্প করার এক পর্যায়ে নমৃতা উঠে দাঁড়াল। বলল,
"সীমান্ত, আমাকে যেতে হবে।"
"কেন? আরেকটু বসো।"
"নাহ, তোমার মা আসছেন।
আমাকে দেখলে উনি রেগে যাবেন। তুমি কিন্তু উনাকে আমার কথা বলবেনা।"
এটুকু বলেই নমৃতা বেরিয়ে গেল। আমাকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়েই। আমি বেশ মন খারাপ করে ভাবলাম "ধুর অযথা মা আসছে বলে চলে গেল। কই মা আসছে? আরও কিভাবে জানল যে মা আসছে?"
খুব রাগও হল আমার। কিন্তু আমাকে চূড়ান্তরকম অবাক করে দিয়ে নমৃতা যাবার পাঁচ মিনিটের মাথায় মা বাড়িতে আসলো।
মা কে দেখে আমার শিরদাঁড়া বেয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত নেমে গেল। ভাবলাম, আশ্চর্য। নমৃতা কিভাবে বুঝলো যে মা আসছে? প্রচন্ড অবাক হয়ে হতভম্ব অবস্থায় ওকে ফোন দিলাম। পেলাম না। ছাদে গেলাম। সেখানেও নেই। খুবই অবাক হয়েছিলাম সেদিন। পরে নমৃতাকে এই নিয়ে জিজ্ঞেস করলে ও বলল, তোমাদের জানালা দিয়ে আসতে দেখেছি। ও আর এই বিষয়ে কথা বলতে চায়নি। আমিও তাই আর ঘাটাইনি।

নমৃতার একটা স্বভাব ছিল। ও হুট করে কলেজে চলে আসত। যদিও ও আমার কলেজে পড়তনা। ও কোথাও পড়তনা। পারিবারিক কোন এক সমস্যার কারণে ওর পড়াশুনা বন্ধ হয়ে যায়। যেদিন ও কলেজে আসতো আমি ওকে নিয়ে ক্যাম্পাসে ঘুরতাম। আর আশেপাশের লোকেরা হাঁ করে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতো আমাদের যেন তারা কোনদিন কোন কাপল দেখেনি। নমৃতা মজা করে বলত,
"দেখ সীমান্ত, আমাদের কিভাবে দেখছে সবাই? আসলে আমাদেরকে একসাথে একদম মানায়না। we ar not made for each other. আর এজন্যই আমি তোমাকে একদিন একা রেখে যাব।" ওর এরকম কথা শুনে আমি ওকে বকা দিতাম। আর ও এমনভাবে হেসে উঠতো, সে হাসির শব্দ এখনও আমার কানে বাজে। যত দিন যাচ্ছিল, আমাদের স্বপ্ন ডালপালা মেলে বৃক্ষে পরিণত হচ্ছিল। বিশেষ করে আমার। আমি সবসময়ই এটা করব ওটা করব, এই হবে সেই হবে বলতাম আর নমৃতা শুধু হুঁ হ্যাঁ করে জবাব দিত। কখনও কখনও আমাদের গল্প চলে যেত চূড়ান্ত রোমান্টিকতায়। এভাবেই চলে যেতে পারত বাকি সময়টাও। কিন্তু একদিন সবকিছু ওলট পালট হয়ে গেল। খুব দ্রুত ক'টা ঘটনা ঘটে গেল।
রাতে ইলেক্ট্রিসিটি চলে যাওয়ায় ঘর অন্ধকার হয়ে ছিল। ঘড়িতে তখন বাজে ১১ঃ৩০. নমৃতার সাথে ফোনে কথা বলছি,

"সীমান্ত"
"বলো"
"তোমাকে ছেড়ে যাবার সময় হয়ে এসেছে।"
"দেখ নমৃতা, তুমি এভাবে বলোনা প্লিজ। খারাপ লাগে।"
"আজকের পর আর খারাপ লাগবেনা। সব ঠিক হয়ে যাবে।"
"কি যে বলো? কোথায় যাবে তুমি?"
"আমিতো কোথাও ছিলামই না সীমান্ত। আমিতো শুধু....."
"হ্যাঁ বলো।"
"তোমার মা আসছেন। আমাকে যেতে দাও।"
"তুমি কেন এমন পাগলামি করছো? প্লিজ মজা করোনা। অনেক হয়েছে।"
"চিন্তা করোনা। আমি আবার আসবো। তোমাকে নিয়ে যেতে। সেদিন তুমি শুধু আ......."

মা ঘরের লাইট টা জ্বেলে আমার হাত থেকে ফোন টা নিয়ে নিলো। বলল,
"ভাঙা ফোন কানে ধরে কি করিস? আর কার সাথে কথা বলছিলি?" আমি কিচ্ছু বুঝতে পারলাম না। কি বলছে মা এসব? মায়ের হাতের দিকে তাকিয়ে দেখলাম ওটা সত্যিই আমার আগের ভাঙা ফোনটা। মা আবার
বলল, "কি হয়েছে তোর বাবা? বল আমাকে। একে তো ঘর আঁধার করে বসে আছিস। তার ওপরে নষ্ট ফোনে কার সাথে যেন কথা বলিস। বল বাবা, কি হয়েছে তোর?" মায়ের কন্ঠে চরম উৎকন্ঠা। কিন্তু আমার মাথায় কিচ্ছু আসছেনা। মাকে সব খুলে বললাম। নমৃতার কথা। আমাদের পরিচয় থেকে শুরু করে প্রণয় পর্যন্ত সব, সবটা জানালাম মা কে। মা সব শুনে আমাকে বলল, "মেয়েটা কোথায় থাকে বললি?"
"পাশের বাসায়। দোতলায়।"
"তা কি করে হয়? পাশের বাসার দোতলায় তো কেউ থাকেনা। বাড়ির মালিক নিজের জন্য রেখে দিয়েছে। আর সেজন্যই তো আমরা এই ফ্লাটে এসে উঠলাম। তোর মনে নেই?"
আমার মাথা চরকির মত পাক খেলো একটা। তার মানে কি নমৃতা নামের কেউ নেই? আমি উঠে গিয়ে আমার ঘরের জানালার পাশে দাঁড়ালাম। যেটা দিয়ে পাশের বাসার দোতলাটা দেখা যায়। হ্যাঁ, পুরো অন্ধকার। কোন জানালাও খোলা নেই। কেউ পর্দার আড়ালে তাকিয়ে নেই আমার দিকে। নমৃতা নেই। ছিলনা কখনও।

এর পরের কয়েকদিনে জীবনযাপন অদ্ভুত হয়ে গেল। আমি উন্মাদের মত আচরণ শুরু করলাম। শেষমেষ মা বাবাকে NY থেকে ডেকে আনলেন।আমাকে নিয়ে তারা শরণাপন্ন হলেন এক সাইকিয়াট্রিস্ট এর। সেই বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের কাউনসিলিং এর ফলে আমি আবার ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হলাম। নমৃতা ছিল আমার অবচেতন মনের একটা কল্পনা। আমি একা ছিলাম। ভীষণ একা। ছোটবেলা থেকেই বাবা মা কেউ আমাকে সেভাবে সঙ্গ দিতে পারেনি। তাই আমার অবচেতন মন নিজেই এমন একজন চরিত্রকে সৃষ্টি করে যে আমার একাকিত্ব দূর করতে পারে। আমার সঙ্গী হতে পারে। সেইই ছিল নমৃতা। এজন্যই নমৃতা সবকিছু আগেই বুঝে ফেলত। কলেজে সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকত কারণ আমি হাঁটতাম একা, কথা বলতাম একা, হাসতাম একা। পাশে কারও অস্তিত্বই ছিলনা। নমৃতা চলে গেছে। কিন্তু আজও ওর প্রতি টান টা রয়ে গেছে। আমি বাস্তবতা মেনে নিয়েছি। যেখানে নমৃতার কোন চিহ্ন নেই। নমৃতা বলেছিল ও ফিরে আসবে। কিন্তু আজ এতগুলো বছর পার হয়ে গেছে। সে আসেনি।

রাত ১১ টা। ব্রিজের ওপর দিয়ে হাঁটছি। বেশ জোরে বাতাস বইছে। রাস্তায় লোকজন নেই। মাঝে মাঝে দুটো তিনটে গাড়ি। নিঝুম নিস্তব্ধ চারিদিক। হঠাৎ পেছন থেকে কেউ আমার নাম ধরে ডাকল। "সীমান্ত" ঘুরে দাঁড়ালাম। চাঁদভাঙা জোছনায় দেখলাম নমৃতা আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। শনশন বাতাসে চুলগুলো উড়ছে ওর।

No comments:

Post a Comment

Related Posts Plugin for WordPress, Blogger...