- আজ অনেক গরম পড়েছে, তাই না রে?
- হ্যাঁ। আসলেই।
মুখটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে বলল সাকিব। বাস স্ট্যান্ডে বসে আছে দুজন। সাকিব আর নিশি। নিশি আর একটু পর বাসে চড়বে। চলে যাবে। চট্টগ্রাম, নিজের বাসায়। সাকিব এসেছে তুলে দিতে বাসে। এর আগেও অনেক বার তুলে দিতে এসেছে। গ্রীষ্মের বন্ধে বাসায় যেত, ঈদের বন্ধে বাসায় যেত, কখনও ফাইনাল পরীক্ষা শেষে বাসায় যেত। প্রতিবারই সাকিবের
কাজ থাকতো, এসে বাসে তুলে দেয়া। যাবার আগে সাকিবের মাথার চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে প্রতিবার বলে, ঠিক মত চলিস তো। ইচ্ছা হলে, বাসায় যাস। আর আমি বেশীদিন থাকব না। চলে আসব। এসেই আবার সারাদিন তোর সাথে, ঘুরাঘুরি, আড্ডা। আচ্ছা?
নিশি এবার আর তা বলবে না। দেখতে দেখতে চার বছর চলে গেল। ভার্সিটির পড়া শেষ। একেবারে বাসায় চলে যাচ্ছে এবার নিশি। সাকিবের এবারও হয়ত বাসায় যাওয়া হবে না। অনেক দিন হল বাসায় যায় না। পাশ করে বের হবার আগেই, এক বড় ভাইয়ের মাধ্যমে চাকরি হয়ে গেছে। তবুও ফর্মালিটি হিসেবে, কাল ভাইভা দিতে যাবে।
চুপচাপ থাকা সাকিবের, ভার্সিটির প্রথম বছর কারও সাথেই কথা হয় নি। নিজে থেকে কথা বলতে পারত না, কেউ এসে কথাও বলত না। দ্বিতীয় বছর, দীপের সাথে ঘুরতে ঘুরতে পরিচয় হয় দুই তিন জনের সাথে। এই দুই তিন জনের মধ্যে নিশি একজন। ক্লাসমেট নিশি। মাঝে মাঝে দেখত, কথা হত না। প্রথম যেদিন দীপ সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়, ক্যাফেটেরিয়ার টেবিলটার এক কোণে মাথা নিচু করে বসে থাকে। বলে না কিছু। মাথা তুলে কথা বলতে, খুব লজ্জা লাগছিল। লজ্জাটা কেন লাগছিল জানে না সাকিব। আসলে ছোটবেলা থেকে, বয়েজ স্কুল কলেজে পড়ার কারণে, কোনদিন মেয়েদের সাথে সখ্যতা হয়ে উঠেনি। হয়ে উঠেনি কারও সাথে বন্ধুত্ব। বলা হয় নি কারও সাথে মন খুলে কথা।
- কোক খা, নে।
মাথা নিচু করে থাকা, সাকিবের দিকে একটা কোকের বোতল বাড়িয়ে দিয়ে, বলেছিল সেদিন নিশি। কাঁপা হাতে বোতলটা নিতে গিয়ে, হাত ফসকে পড়ে যায়। ফ্লোরে পড়ে ভেঙে যায় বোতলটা। কোক গড়িয়ে গড়িয়ে ছড়িয়ে যায় পুরো ফ্লোরে। হেসে দেয় সবাই। কয়েকজন বলেও কিছু চাপা কথা।
-কিরে, সুন্দরী দেখে পাগল হয়ে গেছিস? বোতলের দিকে তাকিয়ে নে, নিশির মুখের দিকে কি?
খারাপ লাগে সাকিবের। ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে মাথা নিচু করে উঠে যায়। বের হয়ে আসে, ক্যাফেটেরিয়া থেকে। গিয়ে বসে থাকে, সামনের বাধানো বড় আম গাছটার নিচে। একটা দুঃখ দুঃখ কাজ করে বুকের ভিতর। একটা অপমান বোধ ছড়িয়ে পড়ে, হৃদয় জুড়ে। গলা খুলে গান গাইতে শুরু করে সাকিব। মন খারাপের সময়টাতেই গান গায়। মনে হয়, মন খারাপ হারিয়ে যাচ্ছে গানের সুরে সুরে, মিশে যাচ্ছে আকাশে বাতাসে। চোখ বুজে গান গায় সাকিব। অনুভব করার জন্য, তাড়িয়ে দেবার জন্য কষ্টগুলো। গান গাওয়া থামিয়ে চোখ মেলে তাকাল সাকিব। পাশ থেকে কেউ বলল, থামলি কেন? ভাল লাগছিল।
চমকে উঠে সাকিব। পাশে এসে বসেছে নিশি। লজ্জায় সাকিবের মুখটা লাল হয়ে গেল। একটা মেয়ে গান শুনেছে সাকিবের, ভাবতেই লজ্জা লাগছে। কিছু না বলে চুপ করে মাথা নিচু করে রইল।
- এই ছেলে, কথা বলতে পারিস না তুই?
সাকিব একটু দম নিয়ে বলল, পারি।
- তাহলে আমি যে বক বক করতেছি। তুই চুপ করে আছিস কেন?
- আমার মেয়েদের সাথে কথা বলতে যেন কেমন লাগে।
- কেমন লাগে?
- ভয় লাগে।
- ভয় লাগে মানে? মেয়েরা কি বাঘ ভাল্লুক? ভয় পাবার কি আছে? আর এতো লজ্জা পাস কেন তুই? বন্ধু আবার ছেলে মেয়ে কি? বন্ধু তো বন্ধুই। সব মেয়ে তো আর তোর সাথে প্রেম করতে আসছে না, যে এতো লজ্জা পাবি।
- হ্যাঁ।
- আমি এতো কিছু বললাম, আর তুই বললি হ্যাঁ? আর কিছু বলতে পারিস না? তুই কি মন খারাপ করছিস, সবাই তোকে নিয়ে হাসাহাসি করাতে?
- না।
- আচ্ছা, সবার হয়ে আমি সরি, ঠিক আছে?
- সরি বলতে হবে না।
- তাও কথা, তুই আমার বন্ধু। বন্ধুকে কেউ সরি বলে?
নিশি এই কথা বলেই, হাত বাড়িয়ে দিল সাকিবের দিকে।
- বন্ধু, আমরা এখন থেকে ঠিক আছে? ভাল বন্ধু, যাকে বলে, দোস্ত।
সাকিব কি করবে বুঝতে পারে না। একটা মেয়ে হাত বাড়িয়ে বসে আছে সামনে, কি করা উচিৎ। মাথা নেড়ে সাকিব বলে, আচ্ছা।
- আচ্ছা কি? হ্যান্ডশেক কর।
সাকিব কাঁপা হাতে, হাতটা দিয়ে নিশির হাতটা স্পর্শ করে। নিশি হাত ধরে হ্যান্ডশেক করে। করেই হেসে দেয়। হেসে হেসে বলে, আমি কিন্তু অনেক কথা বলি। বাঁচাল মেয়ে একটা। আমার সাথে থাকতে হলে, তোরও কিন্তু বাঁচাল হতে হবে। পট পট করবি আমার মত সারাক্ষণ, ঠিক আছে?
- আচ্ছা।
- এসব আচ্ছা, মাচ্ছা, জ্বি, হ্যাঁ চলবে না। এসব সাংকেতিক ভাষা। ভাল করে কথা বলবি।
- আচ্ছা ঠিক আছে। ভাল করে কথা বলব।
বলেই হেসে ফেলে সাকিব।
- তুই হাসতে পারিস? বাহ, এইতো ভাল।
কথায় কথায়, চুপ চাপ ছেলেটা অনেক কথা বলে। কানের কাছে পটপট শুনতে শুনতে, মুখ দিয়েও অনর্গল পট পট করে। আড্ডা দেয়, ঘুরে বেড়ায়। বাধানো আম গাছটার নিচে প্রতিদিন, ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটায়। বন্ধুত্ব , আসলেই অন্য রকম কিছু, অনুভব করতে শিখে সাকিব। চুপচাপ ছেলেটা, চঞ্চল মেয়েটার পাশে আসলেই যেন প্রাণ খুঁজে পেত। নিশির হলের সামনে রাতের বেলাও চলত আড্ডা। সামনের টং এর দোকানে বসে চা খাওয়া। খুনসুটিতে সময় পাড় হয়ে যাওয়া। বন্ধ পেলেই চলে যেত নিশি বাসায়। চট্টগ্রামে। বাসে তুলে দিয়ে আসবার সময়, জোর করে মুখে হাসি ফুটিয়ে রাখত সাকিব। কিছু আশার কথা বলে চলে যেত নিশি। সেই কয়েকটা দিন একাকীত্ব, প্রচণ্ড একাকীত্ব গ্রাস করে ফেলত সাকিবকে। ভাল লাগত না কিছু। একদম না। এক দিন না যেতেই নিশিকে কল করে পাগল করে দিত, চলে আয় না তাড়াতাড়ি । ভাল লাগে না একা একা।
- বাসায় আসলাম একদিন। এখনি চলে আসে কি করে?
- আসবি তুই। না আসলে আমি ঘুমাব না, খাব না।
- এহ, যেন উনি আমার বয়ফ্রেন্ড। খাবে না, ঘুমাবে না। পিটাইয়া হাত পা ভেঙে দিব। ঠিক মত চলবি। চলে আসব তাড়াতাড়ি।
পরদিন আবার একই কথা বলে, চিল্লাচিল্লি করবে সাকিব। নিশি এই পাগলের পাগলামিতে বেশি দিন থাকতে পারে না, বাসায়। চলে আসে। এসে বলে, এই এলাম। এখন কি করবি কর। এতো পাগল হইছিস কেন?
- তোকে না দেখে, ভাল লাগে না।
- এহ ঢং। প্রথম দিকে তো কথাই বলতে চাইতি না। ভাব ধরে চলতি।
- এখন তো বলি।
সময় গুলো চলতে থাকে স্বপ্নের মত। সবাই বলে, ভার্সিটি জীবন মানে অনেক মজার জীবন। প্রথম বছরটা মনে হত সাকিবের কিসের মজা? সারাদিন খালি পড়াশুনা। বিরক্তি কর সময়। খালি , ক্লাস, খাওয়া আর ঘুম। মজা কই?
নিশির সাথে পরিচয়ের পর থেকে, সত্যি মনে হচ্ছে, জীবনটা অনেক সুন্দর। জীবনের অনেক গুলো রঙ দেখছে সাকিব। একেকটা রঙ একেক রকম। কিন্তু প্রতিটা ভাল লাগার। এই ভাললাগার মাঝেও , মাঝে মধ্যেই গা জ্বলে যাওয়া অস্বস্তি আসত। মন খারাপে বিষণ্ণ হত। সাকিবের বন্ধু বলতে শুধু নিশি ছিল। কিন্তু নিশির বন্ধু বলতে শুধু সাকিব না। আরও কয়েক জন আছে। তাছাড়া নিশি সবার সাথেই হেসে হেসে কথা বলে। ভাল করে কথা বলে। কারও সাথে ভাব দেখায় না। মনে হয় যেন সবাই নিশির কত জনমের বন্ধু। নিশির সাথে হাসি ঠাট্টা করে, সেসবে যোগ দেয় নিশি। অন্য কোন ছেলের সাথে নিশিকে দেখতে ভাল লাগে না সাকিবের। সাকিব শুধুই বন্ধু নিশির। তবুও নিশির অন্য কোন ছেলে বন্ধু থাকুক, তা সহ্য হয় না সাকিবের। সাকিবকে বলে নিশি, তুই আমার বেস্ট ফ্রেন্ড।
অন্য কেউ বেস্ট ফ্রেন্ড না হোক। অনেক ফ্রেন্ড তো আছে নিশির। এই ফ্রেন্ডগুলোকে ভাল লাগে না সাকিবের। সাকিব একদিন মানা করে দিয়েছে নিশিকে, তুই আর কখনও অন্য কোন ছেলের সাথে হ্যান্ডশেক করবি না।
- কেন? জ্বলে তোর?
- হ্যাঁ জ্বলে।
হেসে হেসে নিশি বলে, আচ্ছা দোস্ত, করব না। শুধু তোর সাথে করব। এই যে কর হ্যান্ডশেক।
হাত বাড়িয়ে দেয় নিশি, হ্যান্ডশেক করে সাকিব।
আগের থেকে অনেক কম মিশে, সবার সাথে নিশি। সাকিবের রাগ হয়, খারাপ লাগে বুঝতে পেরে। তবুও হুট করে সবাইকে না বলে দেয়া যায় না, যে তোদের সাথে আমি আর কথা বলব না।
তবুও সাকিব তাই চায়। আর কারও সাথে না মিশুক নিশি। নিশির পৃথিবীটা শুধু থাকুক সাকিবকে ঘিরে। এই চাওয়ার নাম বন্ধুত্বের বাহিরে অন্য কিছু কিনা জানত না সাকিব। সাকিব চাইত নিশির মতই, শুধু অনেক ভাল বন্ধু হিসেবে নিশিকে। একদিন খুব ঝগড়া হয় সাকিবের সাথে। এক ক্লাসমেটের জন্মদিনে নিশি যাওয়াতে। সাকিবেরও দাওয়াত ছিল যায় নি। জানত নিশি সাকিব যাবে না। তবুও নিশি গেল।সন্ধ্যা থেকে নাম্বার বন্ধ নিশির। জন্মদিনের অনুষ্ঠান শেষে যখন রাতের বেলা, এসে মোবাইল চালু করে, সাকিব অনেক রাগারাগি করে সেদিন। অনেক কিছু বলার পর বলে, আমাকে তো লাগেনা আর তোর। বন্ধু পেয়ে গেছিস। আমাকে ছেড়ে তাদের জন্মদিনে আনন্দ করতে পারিস। আমি না থাকলেও তোর কিছু না। তোর এতো বন্ধুর মধ্যে থেকে, কেউ একজন তোর বেস্ট ফ্রেন্ড হয়ে যাবে। আমি হারিয়ে গেলে, তুই একবারের জন্যও আমাকে মিস করবি না। এতো বন্ধুর মধ্যে ঠিক ভুলে যাবি। আমার সাথে আর কথা বলতে হবে না তোর। ভাল থাক।
রেখে দেয় সাকিব, এটা বলেই। কথা গুলো মনে হচ্ছিল, বুকের ভিতর বিধছিল নিশির। অনেক কষ্ট হয়, অভিমান হয়। চোখের জল ঝরিয়ে কান্না করে নিশি। রাগ করে কল করে না সাকিবকে। সাকিব কি করে কথাগুলো বলল? এক নিমিষে পর করে দিল। অন্য কেউ নাকি বেস্ট ফ্রেন্ড হবে। সারারাত চোখের জলের একটুও অনুভব করতে পারেনি সাকিব। নিজেই রাগ করে বসে আছে।
পরদিন অনেকক্ষণ বাধানো আম গাছটার নিচে বসে থাকে নিশি। জানে, যত রাগ করেই থাকুক সাকিব আসবে। ঠিক সাকিব এসে বসে নিশির পাশে। মুখ ঘুরিয়ে বসে থাকে অন্য দিকে। সাকিব নিশি কেউ কিছু বলে না। নিশি খানিক পর একটু পাশ ঘেঁষে বসে সাকিবের। পাশে বসে বলে,
- এই দিকে তাকা।
সাকিব মুখ ঘুরিয়ে তাকায়।
-বল।
- রাগ করিস কেন?
- রাগ করি নাই।
- আমার দিকে তাকিয়ে বল, রাগ করিস নাই?
সাকিব তাকাল নিশির দিকে। চুপ করে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ, বলল না কিছু। নিশি বলল, চোখের দিকে তাকিয়ে বল, আমাকে ছাড়া থাকতে পারবি তুই?
- না, পারব না।
- তাহলে কষ্ট দিস কেন?
সাকিব আবার চুপ হয়ে গেল। নিশি আস্তে করে হাত ধরে বলল, কথা দে, পাশে থাকবি সবসময়। আমাকে ভুল বুঝে কখনও দূরে চলে যাবি না। ছেড়ে যাবি না।
সাকিব হাঁ করে তাকিয়ে আছে নিশির দিকে। নিশির গাল বেয়ে পানি পড়ছে। এই রূপ নিশির কখনও দেখেনি সাকিব। এই মায়াময় মুখটা থেকে চোখ ফেরাতে ইচ্ছা করছে না। বুকের ভিতর কেমন যেন করে উঠল সাকিবের। নিশির হাত দুটো শক্ত করে ধরে বলল, কখনও ছেড়ে যাব না। পাশে থাকব। তুইও থাকবি তো?
- হুম থাকব। আমি তোকে ছাড়া থাকতে পারলে তো। তুই বেস্ট ফ্রেন্ড। তুই আমার সব।
সেদিন রাতে ঘুমাবার আগে নিশির মুখটা, বার বার ভেসে উঠছিল চোখের সামনে সাকিবের। গাল বেয়ে পানি পড়া মায়াময় মুখটা। কিছু একটা কাজ করছিল মনের ভিতর। একটা দুর্বলতা, একটা অনুভূতি। এই অনুভূতিটা নতুন। মনে হচ্ছিল অনেক দিন ধরে, বুকের ভিতর চাপা ছিল। হুট করে বের হয়ে আসতে চাচ্ছে। এই অনুভূতিটার একটা নাম দিতে ইচ্ছে করছে, সাকিবের। তবে ভালবাসা ছাড়া আর কোন নাম মাথায় আসছে না। তাহলে কি ভালবেসে ফেলল, নিশিকে? এই ভালবাসা যে বন্ধু হিসেবে না, বুঝতে পারছে সাকিব। অন্য কিছু হিসেবে ভালবাসা। সারারাত চোখের সামনে, নিশির মুখটা দেখে জেগে রইল সাকিব। মনের ভিতর একটা দোটানা কাজ করছে, বলে দিবে নাকি ভালবাসার কথা?
কিন্তু কিভাবে বলবে? নিশি যে শুধু বন্ধু ভাবে। ঠিক যেমন আজকের আগে পর্যন্ত সাকিব ভাবত। আর ভালবাসার কথা বলে দেবার মত, এতো সাহস নেই সাকিবের। এই সাহস টুকুও নিশির দিতে হবে। যতদিন না দিবে, বলতে পারবে না সাকিব। বলার কথা না।
ফাইনাল পরীক্ষা চলে এসেছে। এখন এসব বলে মেয়েটার মাথা নষ্ট না করে দেয়াই ভাল। তিন বছরের বন্ধুত্ব, অন্য কিছুর দিকে যাচ্ছে, এটা মেয়েটার কাছে স্বাভাবিক নাও লাগতে পারে। পরীক্ষা শেষ হোক, তার পরেই বলবে তার চেয়ে।
পরীক্ষা শেষ। এখন চলে যাচ্ছে নিশি। বাসে তুলে দিতে এসেছে সাকিব। এখনও মনের কথাগুলো বলা হয় নি। আজ না বললে, সারাজীবনেও আর বলা হবে না। হারিয়ে যাবে নিশি। আর মাত্র ১০ মিনিট পর বাস ছেড়ে দিবে। গরম পড়েছে খুব। নিশি ঘেমে বসে আছে। সাকিবও।
নিশি বলল, তোকে অনেক মিস করব রে। সময় সুযোগ পেলে আমাদের ঐ দিকে যাস, আচ্ছা? মোবাইল তো খোলাই। চট্টগ্রাম গিয়ে একটা কল দিবি শুধু।
- আচ্ছা। নিশি, তোকে একটা জরুরী কথা বলতে চাচ্ছিলাম।
- হ্যাঁ, বল।
- কিভাবে বলব বুঝতে পারছি না।
- আরে বলে ফেল।
- মানে, আসলে। আসলে আমার চাকরি হয়ে গেছে।
- ঐ পাগল, এই কথা তো কাল বললি।
- ও বলছি?
- হ্যাঁ। পাগল।
আবার মাথার চুল ধরে টেনে দিল নিশি।
- ভাল থাকিস দোস্ত। পাগলামি করিস না। দূরে চলে গেছি একদম ভাববি না। মনে করবি পাশেই আছি। কাছেই আছি। ঠিক আছে?
- আচ্ছা। নিশি তোকে একটা কথা বলব আমি।
- উহ, বার বার কি এমন অনুমুতি নিচ্ছিস। বল না।
গাড়ির হর্ন বেজে উঠল। ছেড়ে দিবে এখনি। নিশি বলল, এই বাস ছাড়বে রে। লাগেজ তুলে দে।
লাগেজ নিয়ে নিশিকে সিটে বসিয়ে দিল সাকিব। বাস ছেড়ে দিচ্ছে। সাকিব নিশির হাতে একটা মোটা কাগজ ধরিয়ে দেয়।
- এটা কি?
- অনেক গরম পড়েছে রে। এটা দিয়ে বাতাস করিস গরম লাগলে।
- হিহি, তুই আসলেই পাগল। দে। ভাল থাকিস। নাম বাস থেকে। ছেড়ে দিল তো।
সাকিব বাস থেকে নেমে গেল। নিশি মাথাটা বের করল জানালা দিয়ে। হাত নেড়ে বিদায় দিচ্ছে সাকিবকে। সাকিব মুখে শুকনো হাসি ফুটিয়ে , হাত নাড়ল। চলে যাচ্ছে নিশি। অনেক দূরে। দূরে অনেক দূরে। দূরত্ব কিছু না। শুধু এতটুকুই মনের কথাটা বলতে পারল না। তবুও নিজেকে আজ প্রথম বারের মত খুব চালাক মনে হচ্ছে। জানে সাকিব কোনদিন ভাললাগার কথা, ভালবাসার কথা, নিশিকে মুখ ফুটে বলতে পারবে না। পারবে না মোবাইলে কল করে বলতে, বা মেসেজ দিয়ে। তাই কাল রাতে ঐ মোটা কাগজটার পিছনে, অনেক সময় নিয়ে, অনেক আবেগ নিয়ে, নিজের মনের কথাগুলো লিখেছে। ভালবাসার কথাগুলো লিখেছে। লিখেছে, নিশি, তোকে অনেক তুমি ডাকতে ইচ্ছে করছে। এই ইচ্ছাটা হবার কারণ আছে একটা। আমি তোকে ভালবেসে ফেলেছি। তোর জন্য কেমন যেন করে বুকের ভিতর। তুই কি আমাকে তুমি ডাকার সুযোগ করে দিবি? সারাজীবনের জন্য তোকে তুমি ডাকতে চাই।
গরমের দিন, জানে নিশির গরম লাগবে। গরমে বাতাস করবার সময়, হাত দিয়ে নেড়ে চেড়ে কাগজটা দেখবেই। আর দেখার সময় সাকিবের মনের কথাগুলো পড়ে ফেলবে।
জানালা খুলে রেখেছে নিশি বাসটার। বাতাস আসছে। চলন্ত বাসের বাতাস। ভালই লাগছে। হাতে সাকিবের দেয়া কাগজটা। পাগল একটা। গরম লাগবে তাই কি একটা পাখা দিল। একটু বাতাস খাবার জন্য কাগজটা নাড়তে লাগল। কিন্তু বাসের বাহিরের বাতাসের কারণে বেশ সমস্যাই হচ্ছে। একটু ঘুরাতে যাবে তখন বাতাসে, জানালা দিয়ে উড়ে চলে গেল কাগজটা। বাতাসে উড়ে উড়ে পড়ে গেল রাস্তায়। নিশি মন খারাপ করে একবার শুধু তাকাল, জানালা দিয়ে বাহিরে। ইশ সাকিবের দেয়া পাখাটা পড়ে গেল। হারিয়ে গেল।
সাকিব হাঁটছে একমনে রাস্তায়। একটা মেসেজ করল নিশিকে, গরম লাগবে, পাখা দিয়ে বাতাস খাস।
নিশির রিপ্লাই আসলো, দোস্ত তোর পাখাটা জানালা দিয়ে পড়ে গেছে। সরি রে।
সাকিব মেসেজটার দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। কি করবে বুঝছে না। শেষ আশাটুকুও হয়ত শেষ হয়ে গেল। কেন যেন মন খারাপ হয়ে গেল। কিছু কথা বলা হোক, তা বোধহয় প্রকৃতিও চায় না। মন খারাপে বুকের ভিতর টনটন করছে। ব্যথা করছে। ব্যথা দূর করতে হবে। সাকিব গাইতে লাগল, ব্যথা দূর করার জন্য, কিছু আশায়, কিছু হারানো জিনিস খুঁজে পাবার জন্য,
"আমার জীবনে স্বপ্ন হয়েছিলে,
শত কষ্টের মাঝে অশ্রু মুছে দিলে,
কত অজানা পথ গেছি হেটে, শুধু তোমায় ভেবে,
হাত এ হাত রেখে কথা দিয়েছিলে, তুমি পাশে রবে।
...
ভুলেও ভাবিনি হারিয়ে যাবে,
স্মৃতিগুলো আমায় এভাবে কাঁদাবে ,
আমি এখনো আছি তোমার আশাতে,
বল তুমি ফিরে আসবে । ।"
গানের সুর ভেসে যাচ্ছে আকাশে বাতাসে। মনের কিছু কথা আকাশে বাতাসে উড়ে নিশির কাছে চলে যাবে না, জানে সাকিব। কাগজে লেখা কথাগুলোর মত, কিছুদূর উড়ে গিয়ে ধুলোর মধ্যে মাখামাখি খাবে। চাপা পড়ে যাবে, কিছুর আড়ালে। সাকিব তেমনি ভালবেসে যাবে, একা একা বলেও যাবে। তবে সে ভালবাসা চাপা পড়ে রইবে, নিশির বন্ধুত্বের আড়ালে।
কিছু কথা বলা হয় না, হয়ে উঠে না। কিছু আবেগ বুঝানো যায় না। অনেক কাছে থেকেও না। বুকের ভিতর চেপে থাকে। চাপা ব্যথা গুলো সবাই উড়িয়ে দিতে পারে না। গানের সুরে, কবিতা গল্পে, কিংবা একা একা ব্যথা গুলো ছড়িয়ে দিতে পারে। তবুও কখনও মুখ ফুটে সব বলতে পারে না সবাই। চোখ বুজে হাত ধরার কথা অনুভব করতে পারে, হাত ধরে থাকতে পারে না। তুই তুমিতে সমীকরণ কষতে পারে, তবুও জীবনের সব সমীকরণ সবাই মিলাতে পারে না। জীবনের জটিল সমীকরণ গুলো কষতে কষতে, কেউ কেউ বার বারই ব্যর্থ হয়।
No comments:
Post a Comment